সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চরে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। সুন্দরবন ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বনভূমিটি, স্বনামে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। জরিপ মোতাবেক ৫০০ বাঘ ও ৩০,০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। বাংলায় সুন্দরবন-এর আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে, যা সেখানে প্রচুর জন্মায়। অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে, এর নামকরণ হয়তো হয়েছে “সমুদ্র বন” বা “চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে)” (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।
মুঘল আমলে (১২০৩-১৫৩৮) স্থানীয় এক রাজা পুরো সুন্দরবনের ইজারা নেন। ঐতিহাসিক আইনী পরিবর্তনগুলোয় কাঙ্ক্ষিত যেসব মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের প্রথম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তত্ত্বাবধানের অধীনে আসা। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর এর কাছ থেকে স্বত্বাধিকার পাওয়ার পরপরই সুন্দরবন এলাকার মানচিত্র তৈরি করা হয়। বনাঞ্চলটি সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভারতের তৎকালীন বাংলা প্রদেশে বন বিভাগ স্থাপনের পর থেকে। সুন্দরবনের উপর প্রথম বন ব্যবস্থাপনা বিভাগের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৯ সালে। ১৯৬৫ সালের বন আইন (ধারা ৮) মোতাবেক, সুন্দরবনের একটি বড় অংশকে সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় ১৮৭৫-৭৬ সালে। পরবর্তী বছরের মধ্যেই বাকি অংশও সংরক্ষিত বনভূমির স্বীকৃতি পায়। এর ফলে দূরবর্তী বেসামরিক জেলা প্রশাসনের কর্তৃত্ব থেকে তা চলে যায় বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। পরবর্তীতে ১৮৭৯ সালে বন ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশাসনিক একক হিসেবে বন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সদর দপ্তর ছিল খুলনায়।
সুন্দরবনের অবস্থান এবং সাগর-নদী ও বনাঞ্চলের নৈসর্গিক দৃশ্যের অপূর্ব সমারোহের জন্য এখানে পর্যটনের অপার সম্ভবনা রয়েছে। সুন্দরবনের মত এত বৈচিত্র পৃথিবীর আর কোন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে নেই। সুন্দরবনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির ছোট বড় বৃক্ষ গুল্মলতা ও পরজীবি উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির পরাশ্রয়ী অর্কিড। বৃক্ষ সম্পদের মধ্যে সুন্দরী সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যা সুন্দরবনের মোট প্রজাতির ৭৩%। অন্যান্য বৃক্ষ সমূহ হলো কেওড়া, বাইন, পশুর, ধুন্দল, কাকড়া, গরান, গোলপাতা ইত্যাদি। সুন্দরবনে মোট ২৬৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণীও রয়েছে। তারমধ্যে আছে ৩২ প্রজাতির মাছ। পৃথিবীর ম্যানগ্রোভ বন সমূহের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনই কেবলমাত্র রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যায়। সুন্দরবনে দেখার জন্য যে সকল স্থান রয়েছে
কটকা: সুন্দরবন পূর্ব অভায়রণ্যের পশ্চিমাংশে সাগরতীরে অবস্থিত কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্র। দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের জন্য রয়েছে ৪টি শর্য্যা বিশিষ্ট ২টি কক্ষ ও ১ ডাইনিং রুম বিশিষ্ট বিশ্রামাগার। মংলা থেকে কটকার দূরত্ব ৮০ কি.মি.। মংলা হতে সাধারণ ট্রলার বা লঞ্চ যোগে কটকা যেতে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা লাগে। অক্টোবর থেকে মার্চ বেড়ানোর জন্য উত্তম সময়।
জামতলা: কটকা খাল পার হয়ে জামতলা অবস্থিত। এখানে জামগাছ বেশী থাকার কারনে জামতলা নাম হয়েছে। জামতলায় বাঘের পরিমান বেশী থাকায় এটি পর্যটকদের জন্য খুব বেশী ভাল জায়গা নয়।
কচিখালী: সুন্দরবন পূর্ব অভয়ারণ্যের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে সাগর তীর ঘেষে সারি সারি তালগাছ আর বাগান নিয়ে গড়ে উঠেছে কচিখালি পর্যটন কেন্দ্র। এখানে রয়েছে একটি বিশ্রামাগার। এখানে বাঘের দেখা পাওয়া যায়। কচিখালী থেকে বনের ভিতর থেকে পায়ে হেটে জামতলা পৌছানো সম্ভব।
বাদামতলা: কচিখালী আর কটকার মধ্যবর্তী স্থানের বাদামতলা। এখানকার সাগর সৈকত অত্যন্ত নির্জন মনোরম। একই সাথে খুব ভয়ংঙ্কর। এখানে বাঘের চলাচল রয়েছে।
তিনকোণা আইল্যান্ড: তিনকোণা আইল্যান্ড সুন্দরবনের ভ্রমণেচ্ছুদের জন্য একটি অন্যতম দর্শনীয় ও আকর্ষনীয় স্থান। পশুর ও মরাপশুর নদীর সংগম স্থলে অবস্থিত।
হাড়বাড়িয়া: কটকা, কচিখালী বা তিনকোণা আইল্যান্ড সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষনীয় স্থান হলেও দূরত্বের কারনে পর্যটকরা অনেক সময় এ সব স্থান দেখতে পারেন না। তবে এক দিনের ভ্রমণের জন্য ভাল স্থান হাড়বাড়িয়া। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য এখানে কিছু কিছু স্থাপনা রয়েছে।
করমজল: অতি অল্প সময়ে ভ্রমণ করার জন্য করমজল সর্বাধিক আকর্ষনীয় স্পট। মংলা থেকে ট্রলারে কমজল পৌছাতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৪০ মি:। এখানে ভ্রমনের জন্য পূর্বানুমতি প্রয়োজন হয় না তবে নির্দিষ্ট হারে ফি প্রদান করতে হয়। এখানে প্রায় ৬০০ মি: এর মত কাঠের পুল রয়েছে যার মধ্য দিয়ে বনের অভ্যন্তরে যাওয়া যায়। এছাড়া এখানে রয়েছে কুমির প্রজনন কেন্দ্র, হরিণ লালন কেন্দ্র এবং একটি ওয়াচ টাওয়ার।
ধানসাগর: ধানসাগর সুন্দরবনের এমন একটি স্থান যেখানে নদী বা খাল না হয়ে সড়ক পথে যাওয়া সম্ভব। মোড়েলগঞ্জ থেকে শরনখোলা পৌছানোর পূর্বে রাজাপুর থেকে ধানসাগর যাওয়া যায়।
মাঝের চর: শরনখোলা থেকে ট্রলারে ৩০ থেকে ৪০ মি. মাঝের চরে পৌছানো যায়। মাঝের চর ভ্রমনের জন্য আকর্ষনীয় স্থান।
মৃগমারী: মংলার চাঁদপাই রেঞ্জ সদর থেকে দূরত্ব পূর্ব দক্ষিণে ৯.৩০ কি.মি. দূরে মৃগমারী একটি সম্ভবনাময় পর্যটন কেন্দ্র। এর পার্শ্ববর্তী নদী শেলা ও মৃগমারী খাল। নিকটে জয়মনি বাজার। মৃগমারী স্থানীয় ভাবে কুমিরের চর নামে পরিচিত।
দুবলার চর: বঙ্গোপসাগরের তীরে এক অপার সৌন্দর্যের স্থান দুবলার চর। এ চরে প্রত্যেক বছর রাস পূর্ণিমায় রাস মেলা উপলক্ষে দেশী বিদেশী অসংখ্য পর্যটক ভিড় করে। এই চর শুটকি মাছের জন্যও বিখ্যাত।
এছাড়া সুন্দর বনে অসংখ্য স্থান রয়েছে।সুন্দরবনের যোগাযোগ ব্যবস্থা
আকাশপথে-ঢাকা থেকে বাগেরহাট: ঢাকা থেকে বাগেরহাটে সরাসরি আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা নাই। তবে ঢাকা থেকে যশোর হয়ে বাস বা ট্যাক্সিতে বাগেরহাট আসা যায।
স্থলপথে: ঢাকা থেকে আরিচা-ঢাকা থেকে ফরিদপুর, যশোর খুলনা হয়ে বাগেরহাট আসা যায়। দূরত্ব প্রায় ৪০০ কি.মি.। সময় লাগে ৮-১১ ঘন্টা। এসি, নন-এসি বিভিন্ন গাড়িতে আসা যায়। ঢাকার মতিঝিল, মালিবাগ, কলাবাগান, শ্যামলী, মিরপুর, উত্তরা, টেকনিক্যাল, গাবতলী থেকে গাড়ি ছাড়ে।
ঢাকা থেকে আরিচা-ঢাকা থেকে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ হয়ে বাগেরহাট আসা যায়। দূরত্ব প্রায় ৩০০ কি.মি.। সময় লাগে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা। ঢাকার মতিঝিল, মালিবাগ, কলাবাগান, শ্যামলী, মিরপুর, উত্তরা, টেকনিক্যাল, গাবতলী থেকে গাড়ি ছাড়ে।
ঢাকা থেকে মাওয়া-গোপালগঞ্জ হয়ে বাগেরহাট আসা যায়। দূরত্ব প্রায় ২০০ কি.মি.। সময় লাগে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা। ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে গাড়ি গুলো ছাড়ে।
নদীপথে-ঢাকা থেকে হুলারহাট পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের লঞ্চ চলাচল করে। সময় লাগে প্রায় ২৪ ঘন্টা। ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ে। হুলোর হাট থেকে সড়কপথে বাগেরহাট আসা যায়।
বাগেরহাট থেকে মংলা সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। মংলা থেকে ট্রলার যোগে সুন্দরবনে বিভিন্ন স্থানে যাওয়া যায়।
তবে উল্ল্যেখ্য করমজল ব্যাতীত সকল স্থানে যাওয়ার জন্য সরকারের পূর্ব অনুমতি নিতে হয়।